
বিশেষ প্রতিবেদন : রসনা বিলাসে অন্যতম পেঁয়াজ। ভারত পেঁয়াজ রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ার পর থেকে এর ঝাঁঝ বেড়ে গেছে কয়েকগুণ অর্থাৎ দাম বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। শুক্রবার ২০০ থেকে ২৪০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে পেঁয়াজ। গতকালও ১৮০ টাকায় বিক্রি হয়েছে অনেক স্থানে। এতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। তাই বলে রসনাবিলাসী বাঙালি পেঁয়াজ ছাড়া থাকবে তা কেমন করে হয়। এমন সংকট কালের জন্য পেঁয়াজের বিকল্প ভেবেছিলেন কৃষি বিজ্ঞানীরা। পেঁয়াজের বিকল্প হিসেবে ব্যবহারের জন্য ‘চিভ’ নামের মসলার জাত চাষে সাফল্যেও পেয়েছেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মসলা গবেষণা কেন্দ্রের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

দীর্ঘদিন ‘চিভ’ নিয়ে গবেষণা শেষে নর্থ চায়না, সাইবেরিয়ান ও মঙ্গোলিয়ান অঞ্চলের মসলা জাতীয় বহুবর্ষজীবী ফসলের এ সাফল্য পান বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের আঞ্চলিক মশলা গবেষণা কেন্দ্রের উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. নূর আলম চৌধুরী। সহযোগী হিসেবে গবেষণার কাজে অংশ নেন করেছেন ড. মোস্তাক আহমেদ, ড. আলাউদ্দিন খান ও মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান চিভের উচ্চ ফলনশীল জাত উদ্ভাবনের লক্ষ্যে দীর্ঘদিন মসলাটির উপর গবেষণা চালান। বিজ্ঞানীদের গবেষণার সাফল্যে হিসেবে বছর জুড়েই চাষ ও ফলনের উপযোগী বারি চিভ-১ নামের একটি জাত উদ্ভাবন করতে সক্ষম হন।
আমাদের রসনাপ্রিয় বাঙালিদের মসলা খাদ্য পেঁয়াজ ও রসুনের স্বাদ বা গুণ থাকায় আপদকালীন সময়ে পেঁয়াজ বা রসুনের বিকল্প হয়ে উঠতে পারে এই ‘চিভ’। এমন ভাবনায় ২০১৭ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টায় বারি চিভ-১ নামের একটি উচ্চ ফলনশীল জাত অবমুক্ত করেছেন। এই চিভকে ঘিরে অনেকটা পেঁয়াজ-রসুনের বিকল্প তৈরিতে আশার সঞ্চার হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মত চীনেও জনপ্রিয় একটি মশলা ফসলের তালিকায় রয়েছে চিভের অবস্থান।

কেন্দ্রের উর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা নূর আলম চৌধুরী জানিয়েছেন, পৃথিবীর অনেক দেশে চিভ সাধারণত স্যুপ, সালাদ ও চাইনিজ ডিসে ব্যবহার হয়। এর পাতা লিলিয়ান আকৃতির ফ্ল্যাট, পাতার কিনারা মসৃণ ও এর ভালভ লম্বা আকৃতির। চিভের স্বাদ অনেকটা আমাদের দেশিয় মশলা পেঁয়াজ রসুনের মত। চিভ হজমে সাহায্য করে, রোগ নিয়ন্ত্রণ করে ও এর মধ্যে ক্যান্সার প্রতিরোধী গুন বিদ্যমান রয়েছে। এর মধ্যে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি, ভিটামিন বি-১, ভিটামিন বি-২, নায়াসিন, ক্যারোটিন ও খনিজ উপাদান বিদ্যমান। চিভ সাধারণত দেশের পাহাড়ী এলাকা সিলেট ও চট্টগ্রামে চাষ হয়ে থাকে। তাছাড়াও এখন অনেকটা দেশের পেঁয়াজ উৎপাদনকারী এলাকা পাবনা, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, মাগুরা, বগুড়া ও লালমনিরহাট এলাকায় এ চিভ চাষের উজ্জল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। একবার চিভ গাছ লাগালে দীর্ঘদিন ধরে ফল পাওয়া যায়। বাড়ির আঙিনায় বা টবে এই ফসলের চাষ করা যায়।
এই বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আরও জানান, বিবিএস ২০১৭ এর তথ্য অনুযায়ী আমাদের দেশে বর্তমানে বাৎসরিক পেঁয়াজ উৎপাদন হয় ১৭.৩৫ লাখ মেট্রিক টন। যদিও দেশে চাহিদা রয়েছে ২২ লাখ মেট্রিক টন। বাকি পেঁয়াজ বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। পেঁয়াজের বিকল্প হিসেবে এই চিভকে ব্যবহার করা গেলে আমদানি নির্ভরতা কমে আসবে। এছাড়াও এই চিভ জাতীয় ফসলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এসব সারা বছর ধরেই চাষ করা যায়।
দেশে পেঁয়াজের ঘাটতি মেটানোর লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষি বিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টায় বিগত ২০১৭ সালে বারি-১ নামের উচ্চফলনশীল চিভ জাতের অবমুক্ত করা হয়। ইতিমধ্যেই এই চাষ সম্প্রসারণে সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ জাতের গাছের উচ্চতা ৩০-৪০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে, পাতার দৈর্ঘ্য হয় ২৩-৩০ সেন্টিমিটার। ভাল্ভ লম্বা আকৃতির এর দৈর্ঘ্য হয় এক থেকে দেড় সেন্টিমিটার পর্যন্ত। প্রতি হেক্টরে পাতাও গাছসহ উৎপাদন হয় ১০-১২ টন। চারা লাগানোর সময় থেকে ৬৫-৭০ দিনের মধ্যে ফসল সংগ্রহ শুরু হয়। বছরে ৪-৫বার ফসল সংগ্রহ করা যায়।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মশলা ফসল বিশেষজ্ঞ আঞ্চলিক মশলা গবেষণা কেন্দ্র (বিএআরআই) গাজীপুরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শৈলেন্দ্র নাথ মজুমদার জানিয়েছেন, পেঁয়াজ রসুনের বিকল্প হিসেবে আদর্শ একটি মশলাজাতীয় ফসল চিভ। এর গুনও পেঁয়াজ-রসুনের চেয়ে বেশী। দেশে ব্যাপকভাবে চিভ চাষ করা গেলে পেঁয়াজ-রসুনের ঘাটতি এই চিভ দিয়ে মেটানো সম্ভব হবে।